যুদ্ধ কি ? যুদ্ধটা আমাদের কাছে কি ? যুদ্ধের প্রকৃত চিত্র কি ? যে সব চিত্র আমরা দেখি সেগুলো যুদ্ধের প্রকৃত চিত্র আমরা দেখতে পাই ? ছবি কি যুদ্ধকে প্রভাবিত করতে পারে ?
এই প্রশ্নগুলো আমার নয়, লেখিকা সুজান সনটাগের, তিনি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে যুদ্ধে তোলা ছবির ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ যেমন করেছেন, তেমনি প্রশ্ন বিদ্ধ করেছেন যারা সেই ছবি দেখছেন তাদেরকেও ।
এ গ্রহের বাসিন্দারা গত একশ বছরে দেখেছে দু দুটো বিশ্বযুদ্ধ, এ ছাড়াও অতি সাম্প্রতিক কালের আফগান যুদ্ধ, ইরান-ইরাক যুদ্ধ, উপসাগরীয় যুদ্ধ, মার্কিন-সিরিয়া যুদ্ধ, আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ এবং নিকট অতীতে ফকল্যান্ড যুদ্ধ কিংবা আরো পিছনে গেলে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ, আমরা পৃথিবীর অন্য প্রান্তে বসে সেই যুদ্ধ ছবিতে দেখেছি, বেতারে শুনেছি, কিন্তু কতটুকু অনুভব করতে পেরেছি সেই যুদ্ধকে ? উপসাগরীয় যুদ্ধটা কেমন আপনার-আমার স্মৃতিতে ? হয়তো বলবেন রাতের আঁধারে ঝাকেঁ ঝাকে আমেরিকার ক্রজ ক্ষেপনাস্ত্র ছোড়ার আলোর ঝলকানিই শুধু মনে পড়ছে, কিংবা সিরিয়ার সাগরতীরে ভেসে আসা কোন আয়লান কুর্দি নামক সিরীয় শিশুর ছোট্ট দেহখানা, কিন্তু আমরা কি দেখেছিলাম বোমা বিষ্ফোরনের সময় সিরিয়ায় কার কিভাবে মৃত্যু হয়েছে কিংবা কার হাত পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শূন্যে উড়ে যাচ্ছে ? না, একদমই দেখি নাই, এমনকি আমরা কোন আমেরিকান সৈন্যর মৃত্যুর দৃশ্যের ছবিও দেখতে পাই নাই, কিন্তু তবুও আমরা স্বীকার করে নিচ্ছি যে সিরীয়ায় একটা যুদ্ধে হয়েছিল, কারণ আমরা আয়লান কুর্দির দেহটা দেখেছিলাম ছবিতে আর ওটাই বলে দেয় যে যুদ্ধ হয়েছিল, মানুষের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছিল এবং সেই কারনে আয়লান কুর্দিরা গ্রীসের উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়ে যেতে ভেসে ছিল সাগরে, কিন্তু তারা সফল হয়নি, অগত্যা সাগরে ডুবে মৃত্যু। এটা একটা ন্যারেটিভ যা আমরা বিশ্বাস করি কারণ ঐ একটি মাত্র ছবিই বলে দিচ্ছে সবকিছু আর কিছু বোঝার বা জানার আদৌ প্রয়োজন নাই অন্তত আজকের দিনে এসে। আমরা আয়লান কুর্দির মুখ দেখি নাই কিন্তু তাতে কিচ্ছু যায় আসে না, সেতো মরেছে যুদ্ধ হয়েছিল বলেই, প্রশ্ন করি নিজেকে আমরা যুদ্ধের ভয়াবহতা কি আদৌও বুঝতে পেরেছি, বেদনাকাতর হতে পেরেছিলাম ? আমি তো আয়লান কুর্দির মুখটা পর্যন্ত দেখি নাই তাহলে কি করে বুঝবো যে কতটা যন্ত্রনাময় ছিল তার মৃত্যু ? ঘরে বসে কি করে বুঝবো যুদ্ধের ভয়াবহতা কতটা নির্মম আর নৃশংস হতে পারে ? আমরা বুঝতে অক্ষম, আর তাই যুদ্ধ আমার আপনার মস্তিস্কে শুধুই কোন একটা ছবি। লেখক সুজান সনটাগ তার বই "রিগার্ডিং দ্য পেইন অব আদার্স" এই কথাটিই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, তিনি বলেছেন .....”যুদ্ধ ক্ষেত্রে মরে যারা, তারা আমাদের কাছে এমনকি স্বপ্নেও খুবই কম পৌছায়। প্রাতরাশের সময়ে আমরা সকালের খবরের কাগজে এই তালিকাটা দেখি, কিন্তু কফির সঙ্গে সঙ্গে সেটা ভুলে যাই ", সোজা কথায় লেখিকা আরও অভিযোগ করেছেন যে "যুদ্ধের আঁচ যাদের দেহে লাগে না,তাদের নিজেদের দৃষ্টি সীমার বাইরে থাকা যুদ্ধের যন্ত্রনায় কিচ্ছু যায় আসে না'
যুদ্ধ ছবি কি তাহলে আমাদের ড্রয়িং রুমের বিনোদন ? কিন্তু তা কি করে হয় ? যুদ্ধের বিভৎস ছবি কি করে আমাদের মত সুস্থ রুচিবোধ সম্পন্ন মানুষের বিনোদন হতে পারে ? বিষয়টা একটু অবাক করা হলেও সত্যি, উদাহরন দেই চলতে পথে দূর্ঘটনায় মাথা থেলতে যাওয়া পথচারীকে কি আমরা ফিরে দেখি না ? দেখি এবং শিহরিতও হই, এটাই আমাদের মানব চরিত্রের এক বৈশিষ্ট, ঠিক এই কারনেই একজন ফটোগ্রাফার যুদ্ধের এমন ছবি তোলেন যা দেখলে আমাদের হৃদয়ে শিহরণ জাগে, আমরা তাৎক্ষনিক বেদনাকাতর হই, এরপর হয়তো যুগে যুগে ঐ ছবিটিই হয়ে উঠে যুদ্ধের একটা সার্বজনীন দেখা ছবি, অর্থাৎ ঐ যুদ্ধ মানেই ঐ ছবিটির কথা সবার মনে পড়বে,সব মানুষের মানষপটে ছবিটি গেঁথে রবে, তারপর অনেক বছর পর যখন বহুবার দেখা ছবিটি আবারও কেউ দেখবে তখন তার কাছে তা শুধুই একটি যুদ্ধের ছবি ? ছবিটি দেখে সে পূর্বের ন্যয় তার মন আর কষ্ট যন্ত্রনা অনুভব করে না, অনুভূতিগুলো অসার হয়ে যায়।
যুদ্ধ কি কোন নৈতিকতা মেনে চলে ? নিকট অতীতের যুদ্ধ দেখে মনে হচ্ছে উত্তর হবে "না"।
যুদ্ধরত পক্ষ দুটো ছবিকে তাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। ঠিক এমনটাই ঘটেছিল সার্ব ও ক্রোয়াটদের মধ্যকার যুদ্ধের সময়, যখন একটি গ্রামের উপর শেল নিক্ষেপের ফলে নিহত শিশুদের ছবিকে উভয় পক্ষ তাদের প্রচারনায় ব্যবহার করে, অর্থাৎ সংবাদের শিরোনামটি পালটে দিয়ে নিজেদের পক্ষে খবরটি প্রচার করেছিল। এই ঘটনাটি লেখকে প্রচন্ড নাড়া দিয়েছিল বলেই হয়তো লিখেছিলেন
"সব ছবিই অপেক্ষা করে, কখন শিরোনাম তাদের ব্যাখ্যা করবে, কিংবা তাদের সঙ্গে কারচুপি করবে", আমরা সাধারন মানুষ তা দেখছি, ঠিক যেমন করে যুদ্ধরত পক্ষগুলো তা দেখাচ্ছেন ।
কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি ছবির কাজ শুধু দেখানো, যা কিছু সত্য তা তুলে ধরা। আফগান যুদ্ধে একজন আফগান যোদ্ধার মৃত্যুর পর যেভাবে একজন আমেরিকান সাংবাদিক ক্ষত-বিক্ষত লাশকে দেখায় ,ঠিক তেমনি করে কি তার নিজের সৈন্যদের ক্ষত-বিক্ষত লাশকে দেখায় ? অবশ্যই না, তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে কেন বিপক্ষেরটা দেখায় আর নিজ পক্ষেরটা দেখায় না ? দেখায় না কারণ নিজ দেশের মানুষের কাছে সত্য গোপন করতে চায়, মনোভাবটা এমন যে একজন আমেরিকান সৈন্য হলো সুপারম্যান, আর সুপারম্যানরা কখনো ক্ষতবিক্ষত শরীরে মৃত্যু বরন করতে পারেনা, তাই সেটা বাস্তবে ঘটলেও দেখানো যাবে না। অর্থাৎ ছবি আংশিক সত্যকে তুলে ধরছে, সম্পূর্ন নয়। কিন্তু এমন ছবিও আছে যা শতভাগ মিথ্যা, যেমন একজন সৈন্য যুদ্ধের ময়দানে গুলি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে আর ঠিক সেই মূহুর্তে ছবিটা তুলেছিলেন জগৎবিখ্যাত ওয়ার ফটোগ্রাফার রবার্ট কাপা, যে ছবিটির নাম তিনি দিয়েছিলেন "ফলিং সোলজার। এই ছবি সম্পর্কে লোকে বলে যে এটি মূলত একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে অংশ নেয়া সৈন্যের ছবি। এমনি আরও অসংখ্য ছবি ছিল যেগুলো সাজানো বলে পরবর্তীতে জানা যায়। ? লেখিকার প্রশ্ন সাজিয়েগুছিয়ে তারপর ছবি তুললে সেই ছবি কি করে যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা তুলে ধরবে ? কিন্তু এমনটাই হয়েছে, একবার না অসংখ্যবার। তবে ভিয়েতনাম যুদ্ধকালীন সময় থেকে আর সাজানো ছবির বিষয়টা উঠে যায়, কারণ তখন টেলিভিষনে কল্যানে মানুষ যুদ্ধকে সরাসরি দেখতে পাচ্ছিলো, তাছাড়া প্রযুক্তির কল্যানে ক্যামেরাও ছোট হতে শুরু করে যা দিয়ে অনেক দ্রুত ও সহজে ছবি তোলা যায়।
আমরা ইউরোপীয়ান যুদ্ধে নিহত সৈন্যদের ছবি দেখি কিন্তু বিপক্ষের সৈন্য হলেও তাদের মুখ দেখানো হয়না ছবিতে, যু্ক্তি হিসেবে দেখানো হয় যে নিহত সৈনিকদের নিকটজন ছবি দেখে বেদনাকাতর হবে। কিন্তু যে ইরাকী সৈন্যটি যুদ্ধে গিয়েছেন এবং মার্কিন সৈন্যদের হাতে নিহত হয়েছেন তার বিভৎস্য লাশের ছবি মার্কিন পত্রিকায় ঘটা করে ছাপা হয় অথচ নিজ দেশের সৈন্যদের ছবি ছাপা হয় না, কিন্তু কেন ? ইরাকি যোদ্ধার পরিবারের সদস্যদের কাছে তাদের নিকট জনের মৃত্যু বেদনাদায়ক হবে না ? অবশ্যই হবে। অদ্ভুত হলেও সত্য যে এই রকমটা ঘটে চলেছে শুধু আফ্রিকা ও এশিয়ার নিহত যোদ্ধাদের বেলায়। ছবি তোলার সময় কেন এই বৈষম্য ? লেখকের ব্যাখ্যা হলো ইউরোপ আমেরিকা হলো "আমরা" আর বাকী পৃথিবী হলো "তোমরা" দলভুক্ত। "তোমরা" দলভুক্তদের বেলায় কিচ্ছু যায় আসে না, এশিয়ানরা হলো কালো, তাই তাদের নিহত সৈনিকদের বিভৎস্য লাশের ছবি কিংবা ফাঁসিতে ঝুলানোর ছবি দেখালেও সমস্যা নেই, এটাই তাদের নিয়তি আর "আমরা" দলভুক্তদের অধিকার বরং যতবেশি খোলামেলা দেখাতে পারবে ততই বীরত্বই ঠিকরে বেরুবে। এই প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে যায় যে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে উপনিবেশিক কলোনিগুলো থেকে লোকজন ধরে এনে ব্রিটেনে খাঁচায় পুরে রাখা হতো আর সভ্য ব্রিটিশরা তাদের দেখতো খাঁচার বাইরে থেকে ঘুরে ঘুরে ঠিক যেমন করে চিড়িয়াখানায় আবদ্ধ পশুদের দেখা হয়।ব্রিটিশরা নিজেদের কে সুপিরিয়র আর কলোনীয়ানদেরকে ইনফিরিয়রস মনে করতো। লেখিকা তাই প্রশ্ন রেখেছেন যে যুদ্ধে নিহত এশিয়া ও আফ্রিকান যোদ্ধারা কি তবে ইউরোপ-আমেরিকার উপনিবেশিক মানুষিকতা শিকার ?
বলা হয় যে ছবি সব সময় অতীতময়, অথাৎ যা কিছু ঘটে গিয়েছে শুধুমাত্র তারই ছবি তোলা সম্ভব, যা এখনো ঘটেনি তার ছবি তোলা অসম্ভব। তারমানে ছবি আমাদেরকে অতীতের কথা স্বরণ করিয়ে দেয়। ১৯৭১ আমাদের বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, যার অসংখ্য ছবি আজ আমরা দেখতে পাই, বিশেষ করে বলতে হয় ভারতীয় ফটোগ্রাফার রঘু রায়ের তোলা ছবির কথা। এসব ছবি আজ যেমন আমরা দেখছি তেমনি দেখছে সেই সব মানুষেরা যারা যুদ্ধকালীন সময়ে ছিলেন এবং আজও বেঁচে আছেন। সেই সময়ের মানুষ যারা এখনো বেঁচে আছেন তাদের কাছে ছবিগুলো সেই সব দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়, স্মতিকাতর করে তোলে আর আমরা যারা তখন হয়তো জন্মই হয়নি তাদের কাছে ছবিগুলো শুধু ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন সময়ের সাক্ষী।যারা ছবি দেখে স্মৃতিকাতর হয়ে যান তাদের প্রত্যেকের স্মৃতিই আলাদা হলেও, নতুন ও পুরনো সব মানুষ একটি বিষয়ে একমত হন যে এই দেশে একটি যুদ্ধ হয়েছিল। অর্থাৎ ছবি এবার যুদ্ধ দেখা ও না দেখা উভয় জনগোষ্ঠিকে স্মৃতিকাতর করে তোলে এবং সেটা অবশ্যই এই একটি বিষয়ে যে, এদেশে যুদ্ধ হয়েছিল এবং সেই যুদ্ধটা ছিল খুবই বিভৎস্য। ছবিগুলো আমাদের মনে গেঁথে যায় সেই স্মৃতির স্বারক হিসেবে। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না, তবুও সময়ের প্রবাহে ছবিগুলো আজ যুদ্ধের বিভৎসতা, নির্মমতা হারিয়ে শুধু ছবি হয়েই রইলো।
যুদ্ধের ছবির প্রদর্শনী কি আমাদের মনজগতে মধ্যে যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা জাগিয়ে তুলতে পারে ?
বিষয়টা এমন যে জঙ্গলের শিকারী সিংহকে ধরে এনে খাঁচায় পুরে তার বন্যতাকে উপলব্দী করার চেষ্টা করা। যুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র বুঝতে হলে তার ছবিকে প্রদর্শনীর আরামদায়ক এয়ারকন্ডিসন কক্ষে স্থাপন করে সম্ভব নয়। তার জন্য চাই উপযুক্ত পরিবেশ। অথচ আমরা প্রদর্শনীর এসব ছবি দেখে বিশাল লম্বা চড়া বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে দেই, এটা শ্রেফ একটা প্রতারনা ছাড়া আর কিছু নয়।
লেখিকা প্রশ্ন করেন যুদ্ধের ভয়াবহতা রুখতে ছবি কি কোন ভূমিকা পালন করতে পারে ? উত্তর হলো "না", কারণ বহুবার চর্বিত চোষনে যেমন কোন সুস্বাদু ফলের আকৃতি নষ্ট হয়, তেমনি বহুবার দেখার কারনে যুদ্ধের বিভৎস্য ছবিগুলোও আমাদের মনের অনুভূতিগুলোকে সক্রিয় করে না, অসার হয়ে যায়।
পরিশেষে বলতে যুদ্ধের ছবি কেমন হবে তা অনেকাংশে নির্ভর করে আমরা যারা দেখি তাদের মনস্তাস্ত্বিক চাহিদার উপর। আমরা এমন ছবি দেখতে যাই যা বিভৎস, যন্ত্রনাদায়ক আর যুদ্ধের ফটোগ্রাফিও আমাদের তাই দেখায়। সারায়োভো যুদ্ধের এক পর্যায়ে অবরুদ্ধ বাসিন্দাদের একজনকে তাই এক ফটোগ্রাফারের উদ্দেশ্যে বলতে শোনা যায় "গোলা ফাটার জন্য অপেক্ষা করছো, যাতে কটা লাশের ছবি তুলতে পার ? "