শিল্পতত্ত্বের গোড়ার পাঠ
মূল বইঃ Art Theory - A very short Introduction
লেখকঃ Cynthia Freeland
শিল্পী একজন স্বাধীন ব্যক্তি স্বত্বা ও তার শিল্পকর্ম সেই স্বাধীন স্বত্বার চিন্তার স্বতঃস্ফুর্ত প্রকাশ মাধ্যম। শিল্প একটি সৃজনশীল কাজ যা ধরা বাধা নিয়মের জালে বন্দি হয়ে সৃষ্টি করা অসম্ভব। আমরা আর কোন কোন প্রেক্ষাপট বিচারে কোন সৃষ্টিকে শিল্প হিসেবে বিবেচনা করবো এবং ইতিহাস থেকে বর্তমান পর্যন্ত শিল্প সৃষ্টির প্রভাবকগুলো কি কি এই বইটির আলোচনার মূল বিষয়।
ইন্ডিজিনিয়াস শিল্পের কথা আমরা জানি যার উৎস ছিল আদিবাসী সংস্কৃতি। আদিবাসীরা তাদের প্রথা বা মিথ মেনে অবচেতন মনের গভীর থেকে সৃষ্টি করেছিল, তারা তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মুখোশ পড়তো কিংবা একজন পুরোহিত চোখে মুখে রক্ত মেখে আধ্যাতিক যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করতো। এখানে মুখোশ ও রক্ত শিল্প সৃষ্টির একটি অনুসঙ্গ যা আজও ব্যবহৃত হচ্ছে। রক্ত বিষয়টির সাথে মানব মনের একটি শিহরণ কিংবা ভয় কিংবা সমীহ সৃষ্টি করা অনুভূতি জড়িয়ে আছে, তাই আজও পারফরমেন্স আর্টের অন্যতম অনূসঙ্গ হিসেবে রক্তের ব্যবহার আমরা দেখতে পাই যদিও রক্তের পরিভাষা বদলে গেছে। যেমন আদিম যুগে রক্তকে পবিত্র জ্ঞান হতো, তাই দেবতাকে খুশি করতে নরবলী দিয়ে রক্ত দেব মূর্তির পায় উৎসর্গ করা হত, কিন্তু আজকের যুগে রক্ত মানেই বিপ্লব, প্রতিবাদের ভাষা, সমর্পন নয়।
শিল্পের সাথে সৌন্দর্যবোধ বা সূরুচিবোধের একটি গভীর সম্পর্ক যেমন আছে, তেমনি আছে কুরুচিবোধেরও। মোনালিসা দেখে আপনার মধ্যে যে বোধই আসুক না কেন, চা পানরত অবস্থায় বিজয়ী সেনাপতি যুদ্ধে পরাজীত সৈনিকের ফাঁসি দেখছেন এমন চিত্র আপনার মনের মধ্যে এক অমানবিক বিপর্যয়ের ছবিই এঁকে দিবে এ বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। তাহলে কি সেই চিত্র শিল্পকর্ম হবে না ? ফ্রান্সিকো গয়ার চিত্রকর্মে এমনটাই আমরা দেখতে পাই। তাহলে শিল্পের পরিভাষা কি আরেকবার বদলে যাচ্ছে না ? শুধুমাত্র সুন্দর আর নান্দনিকতী মানেই শিল্প কর্ম নয়, এর বিপরীতটাও শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বইটির প্রথম অধ্যায় জুড়ে এসবেরই বিশ্লেষণ।
এরপরই আপনি পাবেন শিল্পে অনুকরন তত্ব বা রিপ্রেজেন্টেশান থিওরী। আপনি যদি মিকেলাঞ্জেলো ডেভিড দেখে থাকেন তাহলে বুঝতে পারবেন কেন তাকে জিনিয়াস বলা হয়,অনুকরণ তত্ত্বের এক জলজান্ত নমুনা এই ডেভিড। মানুষ ও তার প্রকৃতিকে কতটা নিঁখুতভাবে ফুটিয়ে তালা হয়েছে এই শিল্পকর্মে তা বিষ্ময় জাগায় আজও। মিকেলাঞ্জেলো এই অনুকরণ তত্ত্বের সাথে যোগ হয়েছিল ধর্মীয় ভাবাদর্শন (The Creation of Adam) তৎকালীন সময়ে খ্রীষ্টীয় চার্চের ভেতরে যে সব শিল্প কর্ম স্থান পেয়েছে তার সবই এই ভাবাদর্শনের শিকার। এমনকি চার্চের কাঠামোও এমন ভাবে সৃষ্টি করা হত যেন তা ধর্মীয় মিথকে সকলের সামনে আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে সহায়ক হয়। তবে ফটোগ্রাফীর আবির্ভাব শিল্পে এই অনুকরণ তত্ত্বের মৃত্যু ঘটায়।আজকের এই আধুনিকোত্তর যুগে অনুকরণ তত্ত্ব নাই, তেমনি নাই ধর্মীয় ভাবাদর্শন দ্বারা প্রভাবিত শিল্প সৃষ্টির প্রথা, কিন্তু দর্শন রয়ে গেছে। ধর্মের জায়গা দখল করে নিয়েছে বানিজ্যিক ভাবনা। আপনি যদি এন্ডি ওয়ারহোলের বিলো বাক্স দেখে থাকেন তাহলেই বিষয়টি সম্পর্কে পরিস্কার ধারনা পাবেন। একটি অতি সাধারন বস্তুও শিল্পকর্ম হতে পারে যদি সেটা জাদুঘরে স্থান পায়। এক্ষেত্রে বস্তুটিকে মহিমান্বিত করা হয় তার সাথে একটি দার্শনিক ভাবনা জুড়ে দিয়ে।
ধর্মীয় ভাবদর্শন ছাড়াও শিল্প প্রভাবিত হতে পারে ভিন্ন সংস্কৃতি দ্বারা। উদাহরন হিসেবে বলতে পারি পাবলোর পিকাসোর Les Demoiselles d'Avignon পেইন্টিংয়ে ব্যবহৃত আফ্রিকান আদিবাসীদের মুখোশের কথা। তেমনি প্রাচীন গ্রীক শিল্পকর্ম সৃষ্টিতে মিশরের স্ফিংস, সিরিয়ার প্রেমদেবী দ্বারা প্রভাবিত ছিল। আরবীয়রা ইউরোপে জন্য বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে তৈরি করা বিভিন্ন মৃৎপাত্রে ক্রুশ আঁকতো। নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস নয়, বানিজ্যিক উদ্দেশ্য ছিল এই শিল্পের প্রভাবক। আরবরা জানত যে খ্রীষ্ট ধর্মালম্বী ক্রেতার নিকট এসব পন্যের তাহিদা বেশি। বানিজ্য ছাড়াও আরও একটি বিষয় এই সাংস্কৃতিক বিনিময়কে সহজতর করতে বড় ভূমিকা রেখেছিল আর সেটা হল উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা।ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক জনগোষ্ঠি একই সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হওয়ার কারনে এই সাংস্কৃতিক বিনিময় সম্ভব হয়েছিল।
শিল্পকে প্রভাবিত করছে আরও একটি মাধ্যম। সেটা হল অর্থনৈতিক বাজার ব্যবস্থা এবং শিল্পকর্ম সংরক্ষণ ও শিল্পমান প্রদানের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ যাদুঘর। লেখকের মতে যখন একটি শিল্পকর্ম অনেক বেশি অর্থে বিক্রি হয় তখন মানুষের মনে শিল্পকর্মটির প্রকৃত গুনাগুন অপেক্ষা অর্থের পরিমানটিই বেশি স্থান পায়। অন্যদিকে খুব ভাল শিল্পকর্ম তখনই সর্বজন স্বীকৃত হয় যখন তা যাদুঘরে স্থান পায়, কিন্তু এসব যাদুঘরের পৃষ্ঠপোষক ও নির্মাতা হয়তো কোন রাজা বা তামাকের ব্যবসায়ী ছিল যারা তাদের সামাজিক সম্মানকে সৃজনশীলতার পৃষ্ঠপোষকতার দ্বারা পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। আমাদের দেশেও আজকাল ব্যাংক বা অন্যান্য অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে যারা এই ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছে। প্রশ্ন উঠতেই পারে যে শিল্পমান বিচারে কতটুকু সততা ও নিরপেক্ষতা এসব প্রতিষ্ঠানের আছে কিংবা আদৌও তারা সেই যোগ্যতা রাখেন কিনা ! ভ্যান গগের স্টেইরি নাইট তার জীবদ্দশায় বোদ্ধারা অবজ্ঞা করলেও আজ তার মূল্যায়ন হচ্ছে,অনুরূপ ইউরোপের অনেক ন্যুড তৈল চিত্র আজ আর শিল্প নয়,এগুলো সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতাবানদের খুশি করা।
শিল্পে লিঙ্গভেদ ও যৌনতার প্রভাব নিয়েও লেখক আলোচনা করেছেন। ইতিহাসে কেন বিখ্যাত কোন নারী শিল্পী নেই, সবাই কেন পুরুষ ? তবে কি নারীদের সৌন্দর্যবোধ নেই ? তাদের মধ্যে অনুভূতি কি কাজ করে না ? তারা কি রোমান্টিক নয় ? এসব প্রশ্নের উত্তর কি ? নারীকে যদি সামাজিক অনুশাসনের জালে যদি বন্দি না করা হত তাহলে কি আমরা ভিঞ্চি বা পিকাসোর মত প্রতিভাবান এক বা একাধিক নারী শিল্পী পেতাম না ? বিস্তারিত আলোচনায় উঠে এসেছে এসব প্রশ্নের উত্তর। এছাড়াও যে বিষয়টি খুবই দেখা যায় যে নারীকেই বারাবার উলঙ্গ করে উপস্থাপন করা হয়েছে। এর পিছনে কি শুধুই শিল্প সৃষ্টির উদ্দেশ্য কাজ করেছে নাকি পুরুষের যৌনতার সহজতার আকর্ষনও কাজ করেছে ? যদি উত্তর হ্যা হয়,তাহলে কি শিল্পের দর্শক শুধু পুরুষ হবে ভেবেই তা সৃষ্টি করেছে ? আমরা কেন সব শিল্প কর্মকে পুরুষের চোখ দিয়েই দেখেছি ? কেন নারীর দৃষ্টিতে নয় ? শিল্প কি তবে পুরুষের একক সম্পত্তি ? এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে বইটিতে।
শিল্প কতটা রাজনৈতিক প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত প্রশ্ন করলেই চলে আসে জাতীয়তাবাদ, জাতীয়তাবোধ সহ অনেকগুলো ডিসকোর্স। আমরা জানি দেখি কিভাবে আজকের শিল্প এসব আদর্শিক মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত। নীটসে, ফ্রয়েড কিংবা কাল মার্কসের নীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শিল্পকর্ম সৃষ্টি হয়েছে। ডাডাইজমের শিল্পীরা রঙ ও তুলিতে কেবল ক্যানভাসকে রাঙিয়ে তাঁদের দায়িত্ব শেষ করেননি, বরং সমকালীন ঘুণেধরা সমাজবিশ্বাসের ভিত্তিমূলে তাঁরা একাযোগে প্রবলভাবে আঘাত করেছিলেন এবং কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন পুঁজিবাদী সভ্যতার পরিচিত মানচিত্র।