যে জীবন তুমি যাপন করনি, কি করে সেই জীবনের গল্প কি করে লিখবে তুমি ? এমন প্রশ্ন যদি কোন লেখককে করা হয় তাহলে উত্তরটা কি হতে পারে ? চলুন সেই উত্তরটাই আগে খুঁজি। ল্যাটিন সমাজে মানুষজন বাস্তবিকই কালোযাদু চর্চায় বিশ্বাসী কিন্তু ইউরোপের সমাজ হল বিজ্ঞানভিত্তিক, তাই যাদু বাস্তবতা নিয়ে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস যখন লিখেন তখন সেটা হয়ে যায় ল্যাটিন সমাজের দর্পন আর একজন ইউরোপিয়ান যখন লিখেন তখন সেটা হয়ে যায় ফ্যান্টাসী। ঠিক একই কারনে অদ্বৈত মল্লবর্মণ যখন লিখেন তিতাস একটি নদীর নাম তখন তা হয়ে যায় মালো তথা জেলে জীবনের এক প্রতিচ্ছবি আর আমি লিখলে সেটা হবে পান্ডিত্য। মার্কেস ছিলেন ল্যাটিন পূত্র আর মালোপূত্র ছিলেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ, এবং তারা দুজনেই তাদের নিজ নিজ শিকড়কে আঁকড়ে ধরে রচনা করেছিলেন তাদের উপন্যাসের প্লট। এই একটি জায়গাটিতেই অদ্বৈত মল্লবর্মণ অন্য আর সবার চেয়ে আলাদা করে নিজের স্থান করে নিয়েছেন তার রচনায় । কি নেই এই উপন্যাসটিতে ! লেখকের এক জীবনে দেখা একটি সম্প্রদায়ের হাসি আনন্দ,সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিরহ-ভালবসা, জয়-পরাজয়, আঘাত-প্রত্যাঘাত, প্রকৃতির বঞ্চনা, মানুষের প্রতারনা, আশা-অপেক্ষা, সব আছে এই উপন্যাস জুড়ে। এ যেন আজন্ম সংগ্রামি মানুষগুলোর সংগ্রামের ইতিহাস কোন এক শিল্পী তার বিশাল ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন সুনিপুন তুলির আঁচড়ে। কখনও মনে হয় এ যেন এক নাটকের মঞ্চ, যেখানে একে একে চরিত্রগুলো হাজির হয়েছে আর যার যার ভূমিকা শেষে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাদের যবনিকাপাত ঘটেছে, তারপর আবার এসেছে নতুন কেউ পুরনোকে সূত্র ধরে এবং কালের স্রোতে একদিন সেও হারিয়ে যায়, তারপর আবার নতুন কেউ এসে তার জায়গা করে নিয়েছে। মোটকথা তিতাসের বয়ে চলা জলের স্রোতধারা পাশাপাশি মালো সম্প্রদায়ের বয়ে চলা সমাজ-জীবনের আখ্যান এই উপন্যাস। এই উপন্যাসে কোন এক বা একাধিক চরিত্র কেন্দ্রীয় ভূমিকায় অবতীর্ন হয়ে আসেনি, এসেছে পুরো সম্প্রদায়ের সামগ্রিক জীবনযাপন, সংস্কৃতির বন্ধন, অসম্প্রদায়িক চেতনা, মানবিকতা,পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আর বিশ্বাসের মজবুত গাথুনি। এমন একটা শুরুর পর উপন্যাসের শেষটা কিন্তু চর পড়া নির্জীব তিতাসের মতই। মালো সম্প্রদায়ের জীবন হয়ে যায় ঝড়ে বিধ্বস্ত বৃক্ষ কিংবা ঝরে পড়া শুকনো পাতার মত, যাকে যে কেউ পা দিয়ে মাড়িয়ে চুরমার করে দিয়ে যায় আর মচমচে শব্দে ভেঙে পড়ার মতই মালোদের আত্মচিৎকার যেন দূর থেকে দূরান্তরে হারিয়ে যাচ্ছিল, তিতাসের বালুচরে তা যেন ছিল একফোটা জলের বিন্দুর মত। কিন্তু এমনতো হওয়ার কথা ছিল না, তিতাসকে ঘিরে যাদের সূর্য উঠে আর সূর্য ডুবে তাদের জীবনের এমন করুন পরিনতি কেন হল ? এমন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য উপন্যাসের সূত্রধর অদ্বৈত মল্লবর্মনের সাথে আমাদেরও তিতাসের পাড় ঘুরে আসতে হবে।
ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার তিতাস নদী মূল নদী মেঘনা থেকে কিছুটা বিচ্যুত হয়ে কিছুটা সরে গিয়ে শুরু হয় এবং পুনরায় মেঘনায় গিয়েই শেষ হয় তার প্রবাহ। স্রোতের তীব্রতা খুব বেশি নয়, ঠিক যেন ক্লাসের শান্ত সৌম্য ছেলেটির মত। এই তিতাস কে ঘিরেই গড়ে উঠেছে মালো সম্প্রদায়। জাল বোনা আর তিতাসের জলে মাছ ধরাই যাদের একমাত্র জীবিকা। যেদিন মাছ ধরতে না পারে সেদিন তাদের উপোস থাকতে হয়। তিতাস তাই এই সম্প্রদায়ের নিকট শুধু নদী নয়, এক পবিত্র স্বত্বা অন্নদাতা, যার জল ছুঁয়ে মিথ্যা কথা বলা যায় না। উপনাসের শেষ দিকটাতে আমরা দেখতে পাই, সুদ সহ ঋণ আদায় করার জন্য পাইক পেয়াদা গ্রামে এসে হামলা চালায়, দূর্দশাগ্রস্থ মালো সম্প্রদায়ের ছেলে-বুড়ো সবাইকে তিতাসের জলে নামায় এবং জিজ্ঞেস করে " ‘ক’ তোর কাছে কত আছে। ..সর্বত্র মিথ্যা বলিলেও তিতাসের জলে নামিয়া মিথ্যা বলা তাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল" এই কথাটি পেয়াদারা জানতো। পেয়াদাদের কৌশল সফল হয় এবং একে একে সবাই তাদের নিজ নিজ শেষ সম্বলটুকু তাদের হাতে তুলে দেয়। এমনই ছিল তিতাস নদী ও মালো সম্প্রদায়ের বন্ধন। সময় বয়ে চলে, একদিন তিতাসের বুকে চর জাগে, মালোদের সাথে তিতাসের নিগূঢ় বন্ধন তাই একদিন হারিয়ে যায় সেই চরের বালিতে। নদীকেন্দ্রীক যে জীবন সংস্কৃতি ছিল তাও বিলুপ্ত হয়, সেই সাথে হারিয়ে যায় মালো সম্প্রদায়ের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও। অন্তঃকলহ কেড়ে নেয় তাদের স্বাংস্কৃতিক বন্ধনকে, যা তাদের সব সময় একটি সম্প্রদায় হিসেবে ঐক্যবদ্ধ রেখেছিল। যে মালো সম্প্রদায় বারমাসে তের পার্বন পালন করতো, বারমাসী গান যাদের কন্ঠে ঝরতো সেই তারাই সেসব ভুলে ধার করা সংস্কৃতির অংশ যাত্রাপালায় গভীর মননিবেশ করে, ফলাফল শুরু হয় অন্তঃকলহ আর দলাদলি। একদল পুরনো সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে থাকার চেষ্টা করলেও বৃহৎ অংশ যোগ দেয় শিকড়বিহীন সংস্কৃতিতে, ভেংগে যায় মালোদের একতা, আর সেই সুযোগে অন্য সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের একতায় আরও বেশি ভাঙন ধরায় এবং তাদের নৈতিক মনবল কে এতটাই দূর্বল করে দেয় যে মালোরা তাদের বউ কন্যাদের সম্ভ্রমও রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেও ভুলে যায়। একদিকে জলশূণ্য তিতাস আর অন্যদিকে দূর্বল নৈতিক মনবল তাদের চুড়ান্তভাবে অর্থনৈতিক-সামাজিক এবং পারিবারিক-ব্যক্তিগত ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। একে একে সবাই অভাবের কাছে আত্মসমর্পন করে, পূর্বে স্বচ্ছল ছিল এমন অনেক গৃহবধুও এই সময়ে এসে ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমে পড়ে। তবে ব্যতিক্রম ছিলেন শুধু একজন, আর তিনি হলেন বাসন্তি। আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন এই নারী সময়ের শেষ অবধি মালো সম্প্রদায়ের অতীত গৌরবের শেষ প্রতিনিধি হিসেবে আত্মমর্যাদা নিয়ে টিকে থাকেন। শত প্রলোভন ও নিপীড়নের পরেও অকাল বিধবা বাসন্তি তার আত্মমর্যাদা বিসর্জন দেয়নি। দিনের পর দিন অভুক্ত থেকে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে সত্বেও অনন্তের কাছ থেকে সাহায্যের চাল গ্রহন না করে আড়ালে চলে যান, কারন এই অনন্তকে একসময় তিনি পূত্রস্নেহে লালন করেছিলেন, তাই আজ তার হাত থেকে তিনি সাহায্যের চাল গ্রহন করতে পারেন না।
পরিশেষে বলব উপন্যাসে বর্ননার গভীরতা এতই ব্যাপক আর বিস্তৃত যে পড়তে পড়তে বারবার মনে হচ্ছিল লেখক এই সম্প্রদায়েরই একজন এবং অনন্ত চরিত্রটি তিনি স্বযং।